Sunday, August 02, 2015

বাঘের কঙ্কাল আছে মাংস নেই

হোসেন সোহেল
 সুন্দরবনের বাঘ মরছে নানা কায়দায়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, প্রকল্পবাজদের চক্রান্ত, হত্যাকারী, পাচারকারী কিংবা তথাকথিত ওষুধের প্রয়োজনে বাঘ হত্যা চলছে। আর বনবিভাগ তো রয়েছে। আমিও রয়েছি এসব সংবাদের পেছনে। সুন্দরবন ও বাঘ নিয়ে সংবাদ সংগ্রহে আমার অলসতা নেই। সেই সাথে এমন অপকর্মে জড়িত ব্যক্তিদের কথাও নিরলসভাবে বলতে পারি।

ডেটলাইন : ১২ – ১৩ মার্চ ২০১১
সাতক্ষিরা, শ্যামনগর, কলাগাছিয়া ফরেস্ট ফাঁড়ি

ভোর ৪টা ৩০ মিনিট। বাঘটি পাশের মালঞ্চ নদী পার হয়ে গোলাখালি গ্রামে অরবিন্দ্রের গোয়াল ঘরে ঢুকে ছয়টি ছাগল খেয়ে ফেলেছে। এদিকে আমি নিশ্চিত বাঘটি আর গোলাখালি গ্রাম থেকে বের হতে পারবে না। অদক্ষ বনকর্মী আর টাইগার প্রজেক্টের কর্মীরাও পারবে না জনগণের রোষানল থেকে বাঘের শেষ নিঃশ্বাস ধরে রাখতে।

শেষ পর্যন্ত তাই হলো। বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে এলাকাবাসী।

অপরদিকে বনবিভাগের লোকজন রাতারাতি বাঘের মরদেহ ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে যেতে চায়। ফোনে বনকর্তাদের অনুরোধ করলাম মৃত বাঘটি কিছু সময়ের জন্য রাখতে, সংবাদের প্রয়োজনে কিছু তথ্য চাই। তাঁরা রাখবেন কি না জানিনা তবে সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগের বনকর্তা জহিরউদ্দীন ও শ্যামনগরের তৎকালীন বুড়িগোয়ালিনী বন অফিসের এসিএফ তৌফিকুল ইসলাম আশ্বাস দিলেন।

সকাল ৭টা, দিনের আলো ফুটছে। সকালের ঠাণ্ডা বাতাস খোলপেটুয়া নদীতে। বাঘের পূর্ণাঙ্গ একটি মরদেহ দেখতে এগিয়ে চলেছি বনকর্মীসহ টাইগার প্রজেক্ট ও পুলিশ সদস্যদের একটি দলের সাথে।
এসিএফ তৌফিক সাহেব কথা দিয়েছিলেন ঠিক কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। ঘটনা স্থলে পৌঁছে দেখি গোলাখালি গ্রাম থেকে মৃত বাঘটি নিয়ে বনবিভাগের দলটি আগেই ট্রলার ছেড়ে দিয়েছে। গন্তব্য গোলাখালি থেকে কলাগাছিয়া বন অফিসে। কলাগাছিয়া ফরেস্ট ফাঁড়ি খানিকটা দূর সুন্দরবনের ভিতরে। শ্যামনগরের ফজলু ও স্থানীয় সাংবাদিক সালাউদ্দিন বাপ্পীর পূর্ব প্রস্তুতির কারণে অন্য ট্রলারে উঠেই ছুটতে থাকলাম বাঘের মরদেহ বহন করা ট্রলারটির পিছু পিছু। এক সময় তাদের নাগাল পেয়ে যাই।
বাঘের মৃতদেহ বহনকারী ট্রলারটির গন্তব্য কলাগাছি ফরেস্ট ফাঁড়ি। গত সাত বছরে শ্যামনগরে পিটিয়ে হত্যা করা আরো তিনটি বাঘ মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে সাতক্ষীরা শ্যামনগর কলাগাছি বন অফিসে।
ঘণ্টাখানেকের পথ পেরিয়ে খোলপেটুয়া নদীর নোনা জলে ট্রলার থেমে যায় কলাগাছিয়ার কাঠের জেটিতে। একটু দূরত্বে বাঘ বহনকারী ট্রলারটি চোখে পড়লেও মৃত বাঘটি তখনো চোখে পড়েনি। কারণ বাঘটির সাথে যারা ছিল সবাই জটলা করে রাজকীয় মহিমাকে দেখছে।

এবার চোখে পড়তেই ধক্ করে ওঠে হৃদপিণ্ড! এত বড় একটি বাঘ! চকচকে ডোরাকাটা দাগ আর নেই। মালঞ্চ নদী তীরের গ্রামবাসী বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা করে কাঁদা মেখে দেয় তার সারা গায়ে। মাথায় জমাট বাধা কালো ছোপ ছোপ রক্ত। একটি চোখ গলে গেছে।  চোখের সামনে বাঘটিকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে বুকটা শূন্য হয়ে গেল।  মৃত বাঘটিকে সামনে রেখে উপস্থিত সবাই একটার পর একটা ছবি তুলছে।
মাটিতে রাখা বাঘটি নিয়ে এবার শুরু হলো দাপ্তরিক কাজ। বনবিভাগের এক কর্মী জানাল  বাঘটির দৈর্ঘ্য ৭ ফুট ১০ ইঞ্চি। চারপাশে একবার চোখ বুলালাম। শ্যামনগর থানার সাত-আটজন পুলিশ সদস্যসহ উপস্থিত প্রায় ৩০ জন আমরা মৃত বাঘটি দেখছি। এর মধ্যে বনবিভাগের কর্মকতা তৌফিকুল ইসলামের সাথে চোখাচোখি হলো, আমাকে দেখে তাঁর কপালে ভাঁজ। আমিও তাঁকে বুঝাতে পারলাম, আমি যা দেখছি তাই সংবাদে প্রচার করব- এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এত কিছুর পরও তিনি আমাকে অবিশ্বাসের চোখে দেখছেন।

সুন্দরবনে বাঘ মারা পড়লে একজন পশু চিকিৎসক বাঘের পোস্টমোর্টেম করেন ।

সাতক্ষীরা পশু হাসপাতালের একজন পশু চিকিৎসক ডা. স্বপন কুমার রায় এসে তারই আনুষ্ঠানিকতা শুরু করলেন। বাঘের বাইরের দিক পর্যবেক্ষণ করে জানালেন বাঘটির বয়স ছিল আনুমানিক ১২ অথবা ১৩ বছর। ডাক্তার সাহেব আরো জানালেন এটা বাঘ নয় বাঘিনী। বাঘিনীর ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত দেখে তিনি জানালেন বাঘটি খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে চলে এসেছে। কারণ বাঘটি শিকার করতে জানে না।

ডাক্তার সাহেব সবাইকে দূরে ঠেলে বাঘটির পোস্টমর্টেমের কাজ শুরু করতে বললেন। চাকু হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন আরম্ভ করলেন চামড়া ছিলার কাজ। বাঘের চামড়া ছাড়ানো-চাট্টি খানি কথা নয়। রাজকীয় চামড়া খুলে তার পাশেই রাখা হলো বাঘের চামড়াহীন দেহ।

এবার কিছুটা বুঝা গেল ছয়টি ছাগল হত্যার দায় কত নির্মম। চামড়াতে ধারালো অস্ত্রের আঘাত তখনো স্পষ্ট। চামড়ার কয়েক জায়গার ছিদ্র নির্মমতার প্রমাণ। ঘাতকদের কী হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে বনকর্তা তৌফিক বলেন বন্যপ্রাণী হত্যার আইন অনুসারে ঘাতকদের শাস্তি প্রদান করা হবে।
চামড়া খুলে ফেললে, সবাই এগিয়ে আসছে বাঘের নগ্ন দেহ দেখতে।

দেহ থেকে আলাদা করা আস্ত লিভারটি নিয়ে ডাক্তার সাহেব বললেন, এটিতে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন রয়েছে। ডাক্তার সাহেব কেটে ফেলা লিভারটি তার সহযোগীর ব্যাগে রাখলেন। উপস্থিত সবাই তাকিয়ে আছে ডাক্তার সাহেবের দিকে কখনো তাঁর ব্যাগে। এবার ফুসফুস কেটে নিয়ে ডাক্তার বললেন, এটা হলো ফুসফুস এটাতে নেকরোসিস হয়েছে।  বলেই ফুসফুসটিও ব্যাগে রাখলেন। সবার মতো আমিও দেখছি একবার ব্যাগ একবার ডাক্তারের মুখমণ্ডল।

এবার প্রশ্ন : ডাক্তার সাহেব কেন বাঘের ফুসফুস ব্যাগে নিলেন?

উত্তর : এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। রোগ নির্ণয়ে এসব অঙ্গ-প্রতঙ্গ পরীক্ষাগারে ঢুকানো হবে। ডাক্তার থেমে থাকলেন না, বাঘিনীর নিতম্বের প্রায় কেজি দুয়েক মাংসও কেটে নিলেন। আমি অবাক হলাম তবে বুঝতে দিলাম না।

খানিক দূরে প্রায় আট ফুট গর্ত করেছে দুজন বনকর্মী। সময় হয়েছে বাঘিনীর চামড়াহীন দেহ মাটিচাপা দেওয়ার। এবার ঘটা করে দাঁড়িয়ে থাকা সবার মধ্যে এক রকম সোরগোল তৈরি হলো। ফিশফিশ আওয়াজ, ভাই আমাকে লেজ থেকে, কেউ বলছে মাথা থেকে, কেউ বলছে দাঁত। আর আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখতে থাকি বিরল সব দৃশ্য।

মাটিতে ফেলে রাখা বাঘটি কৌশলে ঘিরে রাখা হচ্ছে যেন বনকর্তার চোখে না পড়ে। কেউ কেটে নিচ্ছে লেজ কেউ মাংসপিন্ড কেউ আবার নাভির অংশ। যারা বাঘের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও মাংস সংগ্রহ করছে তাদের মধ্যে পুলিশ সদস্য বনকর্মী এমন কি টাইগার প্রজেক্টের কোনো কর্মীও বাদ পড়েনি।
আমি এবার তাকিয়ে বনকর্তার দিকে এবং স্পষ্ট দেখতে পেলাম তিনি আড় চোখে দেখছেন বাঘ লুটের দৃশ্য।

আব্দুল মালেক যে ব্যক্তির ট্রলারে আমরা কলাগাছিয়া ফরেস্ট ফাঁড়িতে পৌঁছেছি, তাকেও দেখেছি এক টুকরো মাংসের জন্য এদিক-সেদিক ঘুরতে। পরে এক টুকরো মাংস হাতে পেয়ে হাসিমুখ মালেক আমার মুখোমুখি। আমাকে সে কিছু বলতে চাইছে তবে ইতস্ত বোধ করছে।

একপর্যায়ে সে বলে, বাঘের মাংস আমার বউ নিতে কইছিল। আপনারা আমার ট্রলারে যাইবেন শুইনে আমার বউ আমারে ঘাটে আইসে কয়ে গেছে। আমি মালেকের কথা শুনছি, সে বলে চললো স্যার বাঘের মাংস দিয়ে সব রোগ সারানি যায়। কীভাবে রোগ সারানো যায় প্রশ্নের উত্তরে মালেক জানালে,  মাংস রোদে শুক্যায়ে গুঁড়া করে অনেক বছর রাখা যায়। অল্প করে দুধের সাথে খাইলে অনেক শক্তি পাওয়া যায়। ট্রলার চালক মালেক আরো একটি সত্যি কথা বলে, আমি তো অল্প পাইলাম অন্যরা যে পরিমাণে নিছে তাতে অনেক টাকা পাইবে। এক কেজি মাংস প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। অনেক কবিরাজ এই মাংস কেনার জন্য সারা বছর তাকায়ে থাকে। সারা বছর তাদের রোগ সারাতি হয় না! বাঘ তো আর সব সময় মরে না।

মালেকের কথা শুনতে শুনতে এবার দেখি, বাঘের গায়ে আর কোনো মাংস নেই। আমার দিকে চোখ পড়তে এবার খাঁকিয়ে উঠলেন বনকর্তা এসিএফ তৌফিক।

বনকর্তার সবাইকে খাঁকিয়ে প্রশ্ন করলেন: এই কাজ কে করল?

কে দেবে কর্তাবাবুর উত্তর? সবার পকেট ও ব্যাগে কলিজা, ফুসফুস, লেজ, মাংস, গোঁফ, নখ কতেকিছু! সব তো চোখের সামনে লুট হয়ে গেল। আর মুহূর্তে ব্যবসা হলো কয়েক লাখ টাকা। তাই উত্তরের আশা না করে বাকি দৃশ্য দেখলাম, পড়ে থাকা বাঘের কংকাল আর বড় একটি ভুড়ি টেনে হেঁচড়ে আট ফুট গর্তে ফেলে দিল দুজন। গর্তে ফেলে দেওয়ার পরও সবার চোখ বাঘের দেহের দিকে। আমিও সে গর্তের দিকে তাকিয়ে অন্য সবার মতো।

তবে স্থান ত্যাগ করার আগে আরো একটি প্রশ্ন ডাক্তার সাহেবের কাছে বাঘটি অরবিন্দ্রের গোয়াল ঘরে ছয়টি ছাগল খেয়েছে তার কী প্রমাণ?

আমার কথা কানে যেতে ডাক্তার বললেন, পাকস্থলী ছিদ্র করে দাও। ডাক্তারের কথায় ছিদ্র হলো। ভুস করে বাতাসও বের হলো, আর তো কিছুই দেখলাম না। ছাগল তো দূরে থাক এক মুঠো খাবারও নাই বাঘটির পাকস্থলীতে।

অনেক শক্ত-পোক্ত করে মাংসহীন কংকাল মাটিতে পুঁতে রাখা হলো। বাঘের জীবন অবসান ও সেই সাথে মাটি চাপার দৃশ্য দেখাতে অন্য কজনের মতো আমাকেও সরকারি ইতিহাসের পাতায় স্বীকারোক্তি দিতে হলো। তাতে লেখা থাকল, সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগার সঠিক ভাবে ‘চিরনিদ্রায় শায়িত’ হয়েছে।

লেখক : পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীবিষয়ক সাংবাদিক