Sunday, August 02, 2015
বাঘের কঙ্কাল আছে মাংস নেই
হোসেন সোহেল
সুন্দরবনের বাঘ মরছে নানা কায়দায়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, প্রকল্পবাজদের চক্রান্ত, হত্যাকারী, পাচারকারী কিংবা তথাকথিত ওষুধের প্রয়োজনে বাঘ হত্যা চলছে। আর বনবিভাগ তো রয়েছে। আমিও রয়েছি এসব সংবাদের পেছনে। সুন্দরবন ও বাঘ নিয়ে সংবাদ সংগ্রহে আমার অলসতা নেই। সেই সাথে এমন অপকর্মে জড়িত ব্যক্তিদের কথাও নিরলসভাবে বলতে পারি।
ডেটলাইন : ১২ – ১৩ মার্চ ২০১১
সাতক্ষিরা, শ্যামনগর, কলাগাছিয়া ফরেস্ট ফাঁড়ি
ভোর ৪টা ৩০ মিনিট। বাঘটি পাশের মালঞ্চ নদী পার হয়ে গোলাখালি গ্রামে অরবিন্দ্রের গোয়াল ঘরে ঢুকে ছয়টি ছাগল খেয়ে ফেলেছে। এদিকে আমি নিশ্চিত বাঘটি আর গোলাখালি গ্রাম থেকে বের হতে পারবে না। অদক্ষ বনকর্মী আর টাইগার প্রজেক্টের কর্মীরাও পারবে না জনগণের রোষানল থেকে বাঘের শেষ নিঃশ্বাস ধরে রাখতে।
শেষ পর্যন্ত তাই হলো। বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে এলাকাবাসী।
অপরদিকে বনবিভাগের লোকজন রাতারাতি বাঘের মরদেহ ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে যেতে চায়। ফোনে বনকর্তাদের অনুরোধ করলাম মৃত বাঘটি কিছু সময়ের জন্য রাখতে, সংবাদের প্রয়োজনে কিছু তথ্য চাই। তাঁরা রাখবেন কি না জানিনা তবে সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগের বনকর্তা জহিরউদ্দীন ও শ্যামনগরের তৎকালীন বুড়িগোয়ালিনী বন অফিসের এসিএফ তৌফিকুল ইসলাম আশ্বাস দিলেন।
সকাল ৭টা, দিনের আলো ফুটছে। সকালের ঠাণ্ডা বাতাস খোলপেটুয়া নদীতে। বাঘের পূর্ণাঙ্গ একটি মরদেহ দেখতে এগিয়ে চলেছি বনকর্মীসহ টাইগার প্রজেক্ট ও পুলিশ সদস্যদের একটি দলের সাথে।
এসিএফ তৌফিক সাহেব কথা দিয়েছিলেন ঠিক কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। ঘটনা স্থলে পৌঁছে দেখি গোলাখালি গ্রাম থেকে মৃত বাঘটি নিয়ে বনবিভাগের দলটি আগেই ট্রলার ছেড়ে দিয়েছে। গন্তব্য গোলাখালি থেকে কলাগাছিয়া বন অফিসে। কলাগাছিয়া ফরেস্ট ফাঁড়ি খানিকটা দূর সুন্দরবনের ভিতরে। শ্যামনগরের ফজলু ও স্থানীয় সাংবাদিক সালাউদ্দিন বাপ্পীর পূর্ব প্রস্তুতির কারণে অন্য ট্রলারে উঠেই ছুটতে থাকলাম বাঘের মরদেহ বহন করা ট্রলারটির পিছু পিছু। এক সময় তাদের নাগাল পেয়ে যাই।
বাঘের মৃতদেহ বহনকারী ট্রলারটির গন্তব্য কলাগাছি ফরেস্ট ফাঁড়ি। গত সাত বছরে শ্যামনগরে পিটিয়ে হত্যা করা আরো তিনটি বাঘ মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে সাতক্ষীরা শ্যামনগর কলাগাছি বন অফিসে।
ঘণ্টাখানেকের পথ পেরিয়ে খোলপেটুয়া নদীর নোনা জলে ট্রলার থেমে যায় কলাগাছিয়ার কাঠের জেটিতে। একটু দূরত্বে বাঘ বহনকারী ট্রলারটি চোখে পড়লেও মৃত বাঘটি তখনো চোখে পড়েনি। কারণ বাঘটির সাথে যারা ছিল সবাই জটলা করে রাজকীয় মহিমাকে দেখছে।
এবার চোখে পড়তেই ধক্ করে ওঠে হৃদপিণ্ড! এত বড় একটি বাঘ! চকচকে ডোরাকাটা দাগ আর নেই। মালঞ্চ নদী তীরের গ্রামবাসী বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা করে কাঁদা মেখে দেয় তার সারা গায়ে। মাথায় জমাট বাধা কালো ছোপ ছোপ রক্ত। একটি চোখ গলে গেছে। চোখের সামনে বাঘটিকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে বুকটা শূন্য হয়ে গেল। মৃত বাঘটিকে সামনে রেখে উপস্থিত সবাই একটার পর একটা ছবি তুলছে।
মাটিতে রাখা বাঘটি নিয়ে এবার শুরু হলো দাপ্তরিক কাজ। বনবিভাগের এক কর্মী জানাল বাঘটির দৈর্ঘ্য ৭ ফুট ১০ ইঞ্চি। চারপাশে একবার চোখ বুলালাম। শ্যামনগর থানার সাত-আটজন পুলিশ সদস্যসহ উপস্থিত প্রায় ৩০ জন আমরা মৃত বাঘটি দেখছি। এর মধ্যে বনবিভাগের কর্মকতা তৌফিকুল ইসলামের সাথে চোখাচোখি হলো, আমাকে দেখে তাঁর কপালে ভাঁজ। আমিও তাঁকে বুঝাতে পারলাম, আমি যা দেখছি তাই সংবাদে প্রচার করব- এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এত কিছুর পরও তিনি আমাকে অবিশ্বাসের চোখে দেখছেন।
সুন্দরবনে বাঘ মারা পড়লে একজন পশু চিকিৎসক বাঘের পোস্টমোর্টেম করেন ।
সাতক্ষীরা পশু হাসপাতালের একজন পশু চিকিৎসক ডা. স্বপন কুমার রায় এসে তারই আনুষ্ঠানিকতা শুরু করলেন। বাঘের বাইরের দিক পর্যবেক্ষণ করে জানালেন বাঘটির বয়স ছিল আনুমানিক ১২ অথবা ১৩ বছর। ডাক্তার সাহেব আরো জানালেন এটা বাঘ নয় বাঘিনী। বাঘিনীর ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত দেখে তিনি জানালেন বাঘটি খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে চলে এসেছে। কারণ বাঘটি শিকার করতে জানে না।
ডাক্তার সাহেব সবাইকে দূরে ঠেলে বাঘটির পোস্টমর্টেমের কাজ শুরু করতে বললেন। চাকু হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন আরম্ভ করলেন চামড়া ছিলার কাজ। বাঘের চামড়া ছাড়ানো-চাট্টি খানি কথা নয়। রাজকীয় চামড়া খুলে তার পাশেই রাখা হলো বাঘের চামড়াহীন দেহ।
এবার কিছুটা বুঝা গেল ছয়টি ছাগল হত্যার দায় কত নির্মম। চামড়াতে ধারালো অস্ত্রের আঘাত তখনো স্পষ্ট। চামড়ার কয়েক জায়গার ছিদ্র নির্মমতার প্রমাণ। ঘাতকদের কী হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে বনকর্তা তৌফিক বলেন বন্যপ্রাণী হত্যার আইন অনুসারে ঘাতকদের শাস্তি প্রদান করা হবে।
চামড়া খুলে ফেললে, সবাই এগিয়ে আসছে বাঘের নগ্ন দেহ দেখতে।
দেহ থেকে আলাদা করা আস্ত লিভারটি নিয়ে ডাক্তার সাহেব বললেন, এটিতে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন রয়েছে। ডাক্তার সাহেব কেটে ফেলা লিভারটি তার সহযোগীর ব্যাগে রাখলেন। উপস্থিত সবাই তাকিয়ে আছে ডাক্তার সাহেবের দিকে কখনো তাঁর ব্যাগে। এবার ফুসফুস কেটে নিয়ে ডাক্তার বললেন, এটা হলো ফুসফুস এটাতে নেকরোসিস হয়েছে। বলেই ফুসফুসটিও ব্যাগে রাখলেন। সবার মতো আমিও দেখছি একবার ব্যাগ একবার ডাক্তারের মুখমণ্ডল।
এবার প্রশ্ন : ডাক্তার সাহেব কেন বাঘের ফুসফুস ব্যাগে নিলেন?
উত্তর : এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। রোগ নির্ণয়ে এসব অঙ্গ-প্রতঙ্গ পরীক্ষাগারে ঢুকানো হবে। ডাক্তার থেমে থাকলেন না, বাঘিনীর নিতম্বের প্রায় কেজি দুয়েক মাংসও কেটে নিলেন। আমি অবাক হলাম তবে বুঝতে দিলাম না।
খানিক দূরে প্রায় আট ফুট গর্ত করেছে দুজন বনকর্মী। সময় হয়েছে বাঘিনীর চামড়াহীন দেহ মাটিচাপা দেওয়ার। এবার ঘটা করে দাঁড়িয়ে থাকা সবার মধ্যে এক রকম সোরগোল তৈরি হলো। ফিশফিশ আওয়াজ, ভাই আমাকে লেজ থেকে, কেউ বলছে মাথা থেকে, কেউ বলছে দাঁত। আর আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখতে থাকি বিরল সব দৃশ্য।
মাটিতে ফেলে রাখা বাঘটি কৌশলে ঘিরে রাখা হচ্ছে যেন বনকর্তার চোখে না পড়ে। কেউ কেটে নিচ্ছে লেজ কেউ মাংসপিন্ড কেউ আবার নাভির অংশ। যারা বাঘের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও মাংস সংগ্রহ করছে তাদের মধ্যে পুলিশ সদস্য বনকর্মী এমন কি টাইগার প্রজেক্টের কোনো কর্মীও বাদ পড়েনি।
আমি এবার তাকিয়ে বনকর্তার দিকে এবং স্পষ্ট দেখতে পেলাম তিনি আড় চোখে দেখছেন বাঘ লুটের দৃশ্য।
আব্দুল মালেক যে ব্যক্তির ট্রলারে আমরা কলাগাছিয়া ফরেস্ট ফাঁড়িতে পৌঁছেছি, তাকেও দেখেছি এক টুকরো মাংসের জন্য এদিক-সেদিক ঘুরতে। পরে এক টুকরো মাংস হাতে পেয়ে হাসিমুখ মালেক আমার মুখোমুখি। আমাকে সে কিছু বলতে চাইছে তবে ইতস্ত বোধ করছে।
একপর্যায়ে সে বলে, বাঘের মাংস আমার বউ নিতে কইছিল। আপনারা আমার ট্রলারে যাইবেন শুইনে আমার বউ আমারে ঘাটে আইসে কয়ে গেছে। আমি মালেকের কথা শুনছি, সে বলে চললো স্যার বাঘের মাংস দিয়ে সব রোগ সারানি যায়। কীভাবে রোগ সারানো যায় প্রশ্নের উত্তরে মালেক জানালে, মাংস রোদে শুক্যায়ে গুঁড়া করে অনেক বছর রাখা যায়। অল্প করে দুধের সাথে খাইলে অনেক শক্তি পাওয়া যায়। ট্রলার চালক মালেক আরো একটি সত্যি কথা বলে, আমি তো অল্প পাইলাম অন্যরা যে পরিমাণে নিছে তাতে অনেক টাকা পাইবে। এক কেজি মাংস প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। অনেক কবিরাজ এই মাংস কেনার জন্য সারা বছর তাকায়ে থাকে। সারা বছর তাদের রোগ সারাতি হয় না! বাঘ তো আর সব সময় মরে না।
মালেকের কথা শুনতে শুনতে এবার দেখি, বাঘের গায়ে আর কোনো মাংস নেই। আমার দিকে চোখ পড়তে এবার খাঁকিয়ে উঠলেন বনকর্তা এসিএফ তৌফিক।
বনকর্তার সবাইকে খাঁকিয়ে প্রশ্ন করলেন: এই কাজ কে করল?
কে দেবে কর্তাবাবুর উত্তর? সবার পকেট ও ব্যাগে কলিজা, ফুসফুস, লেজ, মাংস, গোঁফ, নখ কতেকিছু! সব তো চোখের সামনে লুট হয়ে গেল। আর মুহূর্তে ব্যবসা হলো কয়েক লাখ টাকা। তাই উত্তরের আশা না করে বাকি দৃশ্য দেখলাম, পড়ে থাকা বাঘের কংকাল আর বড় একটি ভুড়ি টেনে হেঁচড়ে আট ফুট গর্তে ফেলে দিল দুজন। গর্তে ফেলে দেওয়ার পরও সবার চোখ বাঘের দেহের দিকে। আমিও সে গর্তের দিকে তাকিয়ে অন্য সবার মতো।
তবে স্থান ত্যাগ করার আগে আরো একটি প্রশ্ন ডাক্তার সাহেবের কাছে বাঘটি অরবিন্দ্রের গোয়াল ঘরে ছয়টি ছাগল খেয়েছে তার কী প্রমাণ?
আমার কথা কানে যেতে ডাক্তার বললেন, পাকস্থলী ছিদ্র করে দাও। ডাক্তারের কথায় ছিদ্র হলো। ভুস করে বাতাসও বের হলো, আর তো কিছুই দেখলাম না। ছাগল তো দূরে থাক এক মুঠো খাবারও নাই বাঘটির পাকস্থলীতে।
অনেক শক্ত-পোক্ত করে মাংসহীন কংকাল মাটিতে পুঁতে রাখা হলো। বাঘের জীবন অবসান ও সেই সাথে মাটি চাপার দৃশ্য দেখাতে অন্য কজনের মতো আমাকেও সরকারি ইতিহাসের পাতায় স্বীকারোক্তি দিতে হলো। তাতে লেখা থাকল, সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগার সঠিক ভাবে ‘চিরনিদ্রায় শায়িত’ হয়েছে।
লেখক : পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীবিষয়ক সাংবাদিক
সুন্দরবনের বাঘ মরছে নানা কায়দায়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, প্রকল্পবাজদের চক্রান্ত, হত্যাকারী, পাচারকারী কিংবা তথাকথিত ওষুধের প্রয়োজনে বাঘ হত্যা চলছে। আর বনবিভাগ তো রয়েছে। আমিও রয়েছি এসব সংবাদের পেছনে। সুন্দরবন ও বাঘ নিয়ে সংবাদ সংগ্রহে আমার অলসতা নেই। সেই সাথে এমন অপকর্মে জড়িত ব্যক্তিদের কথাও নিরলসভাবে বলতে পারি।
ডেটলাইন : ১২ – ১৩ মার্চ ২০১১
সাতক্ষিরা, শ্যামনগর, কলাগাছিয়া ফরেস্ট ফাঁড়ি
ভোর ৪টা ৩০ মিনিট। বাঘটি পাশের মালঞ্চ নদী পার হয়ে গোলাখালি গ্রামে অরবিন্দ্রের গোয়াল ঘরে ঢুকে ছয়টি ছাগল খেয়ে ফেলেছে। এদিকে আমি নিশ্চিত বাঘটি আর গোলাখালি গ্রাম থেকে বের হতে পারবে না। অদক্ষ বনকর্মী আর টাইগার প্রজেক্টের কর্মীরাও পারবে না জনগণের রোষানল থেকে বাঘের শেষ নিঃশ্বাস ধরে রাখতে।
শেষ পর্যন্ত তাই হলো। বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে এলাকাবাসী।
অপরদিকে বনবিভাগের লোকজন রাতারাতি বাঘের মরদেহ ঘটনাস্থল থেকে নিয়ে যেতে চায়। ফোনে বনকর্তাদের অনুরোধ করলাম মৃত বাঘটি কিছু সময়ের জন্য রাখতে, সংবাদের প্রয়োজনে কিছু তথ্য চাই। তাঁরা রাখবেন কি না জানিনা তবে সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগের বনকর্তা জহিরউদ্দীন ও শ্যামনগরের তৎকালীন বুড়িগোয়ালিনী বন অফিসের এসিএফ তৌফিকুল ইসলাম আশ্বাস দিলেন।
সকাল ৭টা, দিনের আলো ফুটছে। সকালের ঠাণ্ডা বাতাস খোলপেটুয়া নদীতে। বাঘের পূর্ণাঙ্গ একটি মরদেহ দেখতে এগিয়ে চলেছি বনকর্মীসহ টাইগার প্রজেক্ট ও পুলিশ সদস্যদের একটি দলের সাথে।
এসিএফ তৌফিক সাহেব কথা দিয়েছিলেন ঠিক কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। ঘটনা স্থলে পৌঁছে দেখি গোলাখালি গ্রাম থেকে মৃত বাঘটি নিয়ে বনবিভাগের দলটি আগেই ট্রলার ছেড়ে দিয়েছে। গন্তব্য গোলাখালি থেকে কলাগাছিয়া বন অফিসে। কলাগাছিয়া ফরেস্ট ফাঁড়ি খানিকটা দূর সুন্দরবনের ভিতরে। শ্যামনগরের ফজলু ও স্থানীয় সাংবাদিক সালাউদ্দিন বাপ্পীর পূর্ব প্রস্তুতির কারণে অন্য ট্রলারে উঠেই ছুটতে থাকলাম বাঘের মরদেহ বহন করা ট্রলারটির পিছু পিছু। এক সময় তাদের নাগাল পেয়ে যাই।
বাঘের মৃতদেহ বহনকারী ট্রলারটির গন্তব্য কলাগাছি ফরেস্ট ফাঁড়ি। গত সাত বছরে শ্যামনগরে পিটিয়ে হত্যা করা আরো তিনটি বাঘ মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে সাতক্ষীরা শ্যামনগর কলাগাছি বন অফিসে।
ঘণ্টাখানেকের পথ পেরিয়ে খোলপেটুয়া নদীর নোনা জলে ট্রলার থেমে যায় কলাগাছিয়ার কাঠের জেটিতে। একটু দূরত্বে বাঘ বহনকারী ট্রলারটি চোখে পড়লেও মৃত বাঘটি তখনো চোখে পড়েনি। কারণ বাঘটির সাথে যারা ছিল সবাই জটলা করে রাজকীয় মহিমাকে দেখছে।
এবার চোখে পড়তেই ধক্ করে ওঠে হৃদপিণ্ড! এত বড় একটি বাঘ! চকচকে ডোরাকাটা দাগ আর নেই। মালঞ্চ নদী তীরের গ্রামবাসী বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা করে কাঁদা মেখে দেয় তার সারা গায়ে। মাথায় জমাট বাধা কালো ছোপ ছোপ রক্ত। একটি চোখ গলে গেছে। চোখের সামনে বাঘটিকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে বুকটা শূন্য হয়ে গেল। মৃত বাঘটিকে সামনে রেখে উপস্থিত সবাই একটার পর একটা ছবি তুলছে।
মাটিতে রাখা বাঘটি নিয়ে এবার শুরু হলো দাপ্তরিক কাজ। বনবিভাগের এক কর্মী জানাল বাঘটির দৈর্ঘ্য ৭ ফুট ১০ ইঞ্চি। চারপাশে একবার চোখ বুলালাম। শ্যামনগর থানার সাত-আটজন পুলিশ সদস্যসহ উপস্থিত প্রায় ৩০ জন আমরা মৃত বাঘটি দেখছি। এর মধ্যে বনবিভাগের কর্মকতা তৌফিকুল ইসলামের সাথে চোখাচোখি হলো, আমাকে দেখে তাঁর কপালে ভাঁজ। আমিও তাঁকে বুঝাতে পারলাম, আমি যা দেখছি তাই সংবাদে প্রচার করব- এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। এত কিছুর পরও তিনি আমাকে অবিশ্বাসের চোখে দেখছেন।
সুন্দরবনে বাঘ মারা পড়লে একজন পশু চিকিৎসক বাঘের পোস্টমোর্টেম করেন ।
সাতক্ষীরা পশু হাসপাতালের একজন পশু চিকিৎসক ডা. স্বপন কুমার রায় এসে তারই আনুষ্ঠানিকতা শুরু করলেন। বাঘের বাইরের দিক পর্যবেক্ষণ করে জানালেন বাঘটির বয়স ছিল আনুমানিক ১২ অথবা ১৩ বছর। ডাক্তার সাহেব আরো জানালেন এটা বাঘ নয় বাঘিনী। বাঘিনীর ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত দেখে তিনি জানালেন বাঘটি খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে চলে এসেছে। কারণ বাঘটি শিকার করতে জানে না।
ডাক্তার সাহেব সবাইকে দূরে ঠেলে বাঘটির পোস্টমর্টেমের কাজ শুরু করতে বললেন। চাকু হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন আরম্ভ করলেন চামড়া ছিলার কাজ। বাঘের চামড়া ছাড়ানো-চাট্টি খানি কথা নয়। রাজকীয় চামড়া খুলে তার পাশেই রাখা হলো বাঘের চামড়াহীন দেহ।
এবার কিছুটা বুঝা গেল ছয়টি ছাগল হত্যার দায় কত নির্মম। চামড়াতে ধারালো অস্ত্রের আঘাত তখনো স্পষ্ট। চামড়ার কয়েক জায়গার ছিদ্র নির্মমতার প্রমাণ। ঘাতকদের কী হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে বনকর্তা তৌফিক বলেন বন্যপ্রাণী হত্যার আইন অনুসারে ঘাতকদের শাস্তি প্রদান করা হবে।
চামড়া খুলে ফেললে, সবাই এগিয়ে আসছে বাঘের নগ্ন দেহ দেখতে।
দেহ থেকে আলাদা করা আস্ত লিভারটি নিয়ে ডাক্তার সাহেব বললেন, এটিতে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন রয়েছে। ডাক্তার সাহেব কেটে ফেলা লিভারটি তার সহযোগীর ব্যাগে রাখলেন। উপস্থিত সবাই তাকিয়ে আছে ডাক্তার সাহেবের দিকে কখনো তাঁর ব্যাগে। এবার ফুসফুস কেটে নিয়ে ডাক্তার বললেন, এটা হলো ফুসফুস এটাতে নেকরোসিস হয়েছে। বলেই ফুসফুসটিও ব্যাগে রাখলেন। সবার মতো আমিও দেখছি একবার ব্যাগ একবার ডাক্তারের মুখমণ্ডল।
এবার প্রশ্ন : ডাক্তার সাহেব কেন বাঘের ফুসফুস ব্যাগে নিলেন?
উত্তর : এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। রোগ নির্ণয়ে এসব অঙ্গ-প্রতঙ্গ পরীক্ষাগারে ঢুকানো হবে। ডাক্তার থেমে থাকলেন না, বাঘিনীর নিতম্বের প্রায় কেজি দুয়েক মাংসও কেটে নিলেন। আমি অবাক হলাম তবে বুঝতে দিলাম না।
খানিক দূরে প্রায় আট ফুট গর্ত করেছে দুজন বনকর্মী। সময় হয়েছে বাঘিনীর চামড়াহীন দেহ মাটিচাপা দেওয়ার। এবার ঘটা করে দাঁড়িয়ে থাকা সবার মধ্যে এক রকম সোরগোল তৈরি হলো। ফিশফিশ আওয়াজ, ভাই আমাকে লেজ থেকে, কেউ বলছে মাথা থেকে, কেউ বলছে দাঁত। আর আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখতে থাকি বিরল সব দৃশ্য।
মাটিতে ফেলে রাখা বাঘটি কৌশলে ঘিরে রাখা হচ্ছে যেন বনকর্তার চোখে না পড়ে। কেউ কেটে নিচ্ছে লেজ কেউ মাংসপিন্ড কেউ আবার নাভির অংশ। যারা বাঘের অঙ্গ-প্রতঙ্গ ও মাংস সংগ্রহ করছে তাদের মধ্যে পুলিশ সদস্য বনকর্মী এমন কি টাইগার প্রজেক্টের কোনো কর্মীও বাদ পড়েনি।
আমি এবার তাকিয়ে বনকর্তার দিকে এবং স্পষ্ট দেখতে পেলাম তিনি আড় চোখে দেখছেন বাঘ লুটের দৃশ্য।
আব্দুল মালেক যে ব্যক্তির ট্রলারে আমরা কলাগাছিয়া ফরেস্ট ফাঁড়িতে পৌঁছেছি, তাকেও দেখেছি এক টুকরো মাংসের জন্য এদিক-সেদিক ঘুরতে। পরে এক টুকরো মাংস হাতে পেয়ে হাসিমুখ মালেক আমার মুখোমুখি। আমাকে সে কিছু বলতে চাইছে তবে ইতস্ত বোধ করছে।
একপর্যায়ে সে বলে, বাঘের মাংস আমার বউ নিতে কইছিল। আপনারা আমার ট্রলারে যাইবেন শুইনে আমার বউ আমারে ঘাটে আইসে কয়ে গেছে। আমি মালেকের কথা শুনছি, সে বলে চললো স্যার বাঘের মাংস দিয়ে সব রোগ সারানি যায়। কীভাবে রোগ সারানো যায় প্রশ্নের উত্তরে মালেক জানালে, মাংস রোদে শুক্যায়ে গুঁড়া করে অনেক বছর রাখা যায়। অল্প করে দুধের সাথে খাইলে অনেক শক্তি পাওয়া যায়। ট্রলার চালক মালেক আরো একটি সত্যি কথা বলে, আমি তো অল্প পাইলাম অন্যরা যে পরিমাণে নিছে তাতে অনেক টাকা পাইবে। এক কেজি মাংস প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। অনেক কবিরাজ এই মাংস কেনার জন্য সারা বছর তাকায়ে থাকে। সারা বছর তাদের রোগ সারাতি হয় না! বাঘ তো আর সব সময় মরে না।
মালেকের কথা শুনতে শুনতে এবার দেখি, বাঘের গায়ে আর কোনো মাংস নেই। আমার দিকে চোখ পড়তে এবার খাঁকিয়ে উঠলেন বনকর্তা এসিএফ তৌফিক।
বনকর্তার সবাইকে খাঁকিয়ে প্রশ্ন করলেন: এই কাজ কে করল?
কে দেবে কর্তাবাবুর উত্তর? সবার পকেট ও ব্যাগে কলিজা, ফুসফুস, লেজ, মাংস, গোঁফ, নখ কতেকিছু! সব তো চোখের সামনে লুট হয়ে গেল। আর মুহূর্তে ব্যবসা হলো কয়েক লাখ টাকা। তাই উত্তরের আশা না করে বাকি দৃশ্য দেখলাম, পড়ে থাকা বাঘের কংকাল আর বড় একটি ভুড়ি টেনে হেঁচড়ে আট ফুট গর্তে ফেলে দিল দুজন। গর্তে ফেলে দেওয়ার পরও সবার চোখ বাঘের দেহের দিকে। আমিও সে গর্তের দিকে তাকিয়ে অন্য সবার মতো।
তবে স্থান ত্যাগ করার আগে আরো একটি প্রশ্ন ডাক্তার সাহেবের কাছে বাঘটি অরবিন্দ্রের গোয়াল ঘরে ছয়টি ছাগল খেয়েছে তার কী প্রমাণ?
আমার কথা কানে যেতে ডাক্তার বললেন, পাকস্থলী ছিদ্র করে দাও। ডাক্তারের কথায় ছিদ্র হলো। ভুস করে বাতাসও বের হলো, আর তো কিছুই দেখলাম না। ছাগল তো দূরে থাক এক মুঠো খাবারও নাই বাঘটির পাকস্থলীতে।
অনেক শক্ত-পোক্ত করে মাংসহীন কংকাল মাটিতে পুঁতে রাখা হলো। বাঘের জীবন অবসান ও সেই সাথে মাটি চাপার দৃশ্য দেখাতে অন্য কজনের মতো আমাকেও সরকারি ইতিহাসের পাতায় স্বীকারোক্তি দিতে হলো। তাতে লেখা থাকল, সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগার সঠিক ভাবে ‘চিরনিদ্রায় শায়িত’ হয়েছে।
লেখক : পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীবিষয়ক সাংবাদিক
বাঘ গুনতেই বাঘের সর্বনাশ
হোসেন সোহেল॥
প্রাকৃতিক বিস্ময় সুন্দরবনে কদিন আগে বেশ ঘটা করেই গণনা করা হয়েছে বাঘের সংখ্যা। বেশ ভালো কথা। ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশেরই জাতীয় পশুটির প্রকৃত সংখ্যাটা বর্তমানে ঠিক কত তা জানা প্রয়োজন। কিন্তু তারপরও কেন প্রশ্ন উঠছে এই বাঘ গণনা নিয়ে?
এবার সুন্দরবনের বাঘ গণনায় ব্যবহার করা হয়েছে ‘ক্যামেরা ট্র্যাপিং’ বা ফাঁদ পেতে ছবি তোলা পদ্ধতি। এর আগে সর্বশেষ ২০০৪-০৫ সালে পাগ-মার্ক বা পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে এই বাঘশুমারি করা হয়েছিল। সে পদ্ধতিতে নাকি ত্রুটি থাকায় এবার আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, বন বিভাগের লোকজনের ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতি নিয়ে। জানা গেছে, অল্প সময়ে বেশি কাজ আদায়ের জন্য সুন্দরবনে না কি বাঘকে আকৃষ্ট করতে বেটিং করা হচ্ছে।
এখানে বেটিং এর মানে হলো টোপ দেওয়া। অথবা খাবারের লোভ দেখিয়ে কোনও পশুপাখির ছবি তোলা বা পশুকে পাখিদের হাতের নাগালে আনার চেষ্টা করা। অনেক সময় বনে বিভিন্ন জন্তুকে হাতের নাগালে পাওয়ার জন্য শিকারীরা জীবন্ত কোনও প্রাণী বেঁধে রাখেন বা কোনও গন্ধ হয়ে যাওয়া পচা প্রাণীর মৃতদেহ ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুসারে সংরক্ষিত প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে থাকা বন্যপ্রাণীদের জন্য কোনও ধরনের টোপ বিশেষ করে গৃহপালিত জীবজন্তু টোপ হিসেবে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কারণ এর মাধ্যমে বনের প্রাণীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকসহ নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে চরম হুমকির মুখে পড়তে পারে বন্য প্রাণীর সংখ্যা। কিন্তু তারপরও আইন লঙ্ঘন করেই চালানো হয়েছে এই বেটিং।
কীভাবে কাজ করে ক্যামেরা ট্র্যাপিং:
বর্তমানে ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়। এ পদ্ধতিতে কোনও মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্যপ্রাণীদের ছবি পাওয়া যায়। বন্যপ্রাণী চলাচলের রাস্তায় দীর্ঘ মেয়াদের ব্যাটারিচালিত ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। এরপর মানুষহীন এ ক্যামেরার সামনে যে নড়াচড়া করবে তখনই উঠতে থাকবে একের পর এক ছবি। এভাবে গবেষকরা পাচ্ছেন দিন বা রাতের আঁধারে লুকিয়ে থাকা বন্যপ্রাণীদের চারিত্রিক বৈশিষ্টসহ নতুন সব তথ্য।
বনবিভাগের অক্কেলহীন কর্মকাণ্ডের দলিল
সুন্দরবনে বাঘজরিপের ছাগলকে টোপ বানানো হয়েছে। বেশ কদিন ধরে এমন কথা কানে আসছিল। কিন্তু স্পষ্ট উৎস খুজে পাচ্ছিলাম না। সুন্দরবনের বাঘ ছাগলের যে গল্প কানে এসেছে আমার কাছে এর গুরুত্ব অবশ্য আলাদা। এর আগেও এমন কর্মকাণ্ডের নজির আছে। বাঘ ছাগলের কানাকানির খবরের অস্বচ্ছতা নিয়ে মাস দুয়েক কেটে গেল।
২০১৪ সেপ্টেম্বর মাস। একটি ফোন। ওপাশের একজন বললেন, সুন্দরবনের ভেতরে ছাগলকে টোপ বানিয়ে বাঘের জরিপ করা হচ্ছে সন্ধান করে দেখুন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তিটি বনবিভাগে কর্মরত আছেন। তাই বিশ্বাসের পাল্লা খানিকটা ভারি হলো। সে সাথে একটু বিপদেও ফেলে দিলেন তিনি। কারণ এর বেশি আমাকে কিছুই বললেন না। যাইহোক মাস দুয়েক আগে কানের পাশে কানাকানি তাহলে ভুল ছিল না।
বনকর্তার ফোনালাপের আরও চারদিন পর একজন বন্যপ্রাণী চিত্রগ্রাহক জানালেন আরও কিছু। তার বক্তব্য আরও ভয়ঙ্কর। সুন্দরবনের ভেতরে একটি নয় প্রায় ৫০টি ছাগলকে বেটিং করে বা টোপ বানিয়ে বাঘজরিপ চলছে। এমন কথা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। সুন্দরবন শুধু সংরক্ষিত বন নয় বরং নানা বৈচিত্র্যময় প্রজাতির একটি জীবন্ত গবেষণাগার। ২০১২ সালে সংশোধিত বন্যপ্রাণী আইন তো বটে পুরো বিশ্বে বাঘের অভয়ারণ্যে বাস্তুসংস্থানের ব্যাঘাত ঘটিয়ে গৃহপালিত জীবজন্তু প্রবেশ করানো আইনবহির্ভূত কাজ। কারণ সুন্দরবনের বিচরণ করা প্রতিটি প্রাণী খাদ্যশৃঙ্খলে একে অপরের সহযোগিতায় বেঁচে থাকে। যেখানে মানব সভ্যতার কোনওরকম হস্তক্ষেপ প্রয়োজন পড়ে না। তাই মানুষের গৃহপালিত প্রাণী সুন্দরবনে প্রবেশ করালে শুধু সুন্দরবনের নয় যেকোনও বন্যপরিবেশ বিপর্যয়ে পড়তে পারে।
অন্যদিকে বাঘের টোপ যখন ছাগল তখন জানার খাতিরে অনেক প্রাণীবিদদের সঙ্গে কথা হলো। এক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য স্পষ্ট, পৃথিবীতে কোনও বিজ্ঞানে বলা নেই যেখানে বুনো বাস্তুসংস্থান চক্র বা সংরক্ষিত বনে কোনও গৃহপালিত পশুপাখি প্রবেশ করানো হয়। এটি প্রকৃতি বিরুদ্ধ আচরণ এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রকৃতির ধ্বংসের একটি পায়তারা।
সময় গড়িয়ে যায়, বিষয়টি সত্যি যদি হয় তাহলে এটি পৃথিবীতে নজিরবিহীন একটি ঘটনা। সাংবাদিকতার খাতিরে এটি জানা আছে যে, এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলবে না। এরপরও জরিপের বিস্তারিত তথ্য বাঘের স্বার্থেই জানতে হবে এবং সবাইকে জানাতে হবে। তাই পিছিয়ে থাকলে চলবে কেন!
উপরে বলেছি, বনবিভাগের যে ব্যক্তি আমাকে ফোনে জানিয়েছিলেন, আবার ফোন দিলাম তাকে। যদিও শর্ত ছিল তার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে না। গতি না পেয়ে শর্ত ভেঙে তার কাছে এবার জানতে চাইলাম জরিপের কাজে নিয়োজিত ছাগল সরবরাহকারী কে।
ঢাকা থেকে ছাগল বিক্রেতা ফোন দিয়ে প্রায় ৫০টি ছাগল কেনার কথা বলি। এরপর নানান কথায় জানতে পারলাম সে খুলনা বন অফিসে ছোট পদে চাকরি করে। সে ছাগল বিক্রেতা নয় বনকর্তার নির্দেশে সে ছাগল সংগ্রহ করেছিল। তবে এতো ছাগল সরবরাহের কথায় সে প্রতিটি ছাগল ২৫০০ টাকা করে দেবে বলে জানালো। যদিও তিনি বিক্রেতা নয়। আরও জানালো ছাগল সংগ্রহে তার সময় লাগবে, কারণ বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাগলগুলো সংগ্রহ করতে হবে। কথার ছলে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- বনবিভাগ কী কারণে ছাগল নিয়েছিল এবং সংখ্যা ঠিক কত। সে এসব কথার উত্তর দিতে চাইল না। আমি আর চাপাচাপিতে না গিয়ে বরং তার সঙ্গে খুলনায় দেখা করার তারিখ ঠিক করলাম।
আলতাফের মুখোমুখি: ছাগল কেনার গল্প
ঢাকা থেকে খুলনা কয়রা বন অফিসের সামনে। বয়স চল্লিশেরও বেশি। তার নাম আলতাফ। লুঙ্গি পরে নির্দিষ্ট একটি চায়ের দোকানে এলো। কিছু সময় নিল আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে। আমার পরিচয় তার কাছে ছাগল ক্রেতা হিসেবে।
যাইহোক, আলতাফের সঙ্গে কথা এগিয়ে চলছে। সেইসঙ্গে ছাগল দিতে তার কতদিন লাগবে এবং কত দাম পড়বে। এসব কথোপকথনের মাঝে এবার যা শুনলাম তাতে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। বাঘজরিপের জন্য ৫০টি নয় প্রথম ধাপে ২০০টি ছাগল সংগ্রহ করেছে বনবিভাগ।
আলতাফ বলে চললো, বড় স্যার মানে বিভাগীয় কর্মকর্তা জাহেদুল কবিরের নির্দেশে কয়েক দফায় ছাগল কেনা হয়েছিল। কোনওটা ২২০০ আবার কোনওটা ২৫০০ টাকা করে পড়েছিল। আমরা তো প্রায় শ দুয়েক ছাগল কিনেছিলাম। প্রতিবার ৫০টি করে ছাগল কেনা হয়েছে। একজন ফরেস্ট রেঞ্জারের বাড়ি খুলনায় তার গ্রাম থেকে কেনা হয়েছে। সরকারি জিনিস তাই সব কাগজপত্র দিয়ে কেনা হয়েছে। তবে যে যার লাভ করে নিয়ে এরপর সরকারি দাম দেওয়া হয়েছে। ছাগল কিনে এরপর ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে জানায়, ছাগলে যদি কোনও জীবাণু থাকে। জীবাণু থাকলে তো বাঘ মারা যেতে পারে। ছাগল দিয়ে কী করলো? এমন প্রশ্নের উত্তরে আলতাফ বলল, ছাগল বাঘের সামনে দেওয়া হয়েছিল, এরপর সেখানে সিসি ক্যামেরা লাগানো ছিল। তারপর বাঘ আসতো এবং ছবি তোলা হতো। এরপর ছাগলগুলোর কী হতো? এই প্রশ্নের উত্তরে সে বলে- বাঘ সব ছাগল খাইয়া চলে যাইতো। কোনও ছাগল আর ফিরে আসেনি।
বনকর্তার মুখোমুখি: মিথ্যাচার ও টালবাহানা
আলতাফের সঙ্গে আলোচনার পর এবার মুখোমুখি বিভাগীয় বনকর্তা জাহিদুল কবিরের কাছে। তার সঙ্গে আগে কোথাও দেখা হয়নি তবে টিভি ও পত্রিকার কল্যাণে আমাকে চিনে নিলেন।
প্রশ্ন: আপনি বাঘজরিপে কেনও ছাগলকে টোপ বানিয়েছেন?
উত্তর: এমন বাজারি তথ্য আপনারা কোথায় পান? কেউ বললো আর সব হয়ে গেলো?
প্রশ্ন: এই ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন ?
উত্তর: হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়েন
প্রশ্ন: আপনারা বাঘজরিপের জন্য প্রথম ধাপেই অনৈতিকভাবে ২০০টি ছাগল সুন্দরবনে প্রবেশ করিয়েছেন।
এরপর তিনি পুরোটাই অস্বীকার করে আমাকে আবারও অনেক কিছু বোঝানো শুরু করলেন।
ওনার সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, আমাদের আসলে প্রমাণ দরকার। এই প্রমাণ যোগাড় করতে প্রয়োজন নৌকা চালককে। তাকে পেলে জানা যাবে কীভাবে বাঘের সামনে ছাগলকে টোপ বানিয়ে রেখেছিল।
পুরো দুদিন সন্ধানের পর লিটন নামের নৌকাচালককে অবশেষে পেলাম মংলার মামা ঘাট নামক মংলাই নদীর তীরে। বাঘজরিপের প্রথম পর্বের সঙ্গে জড়িত ছিল লিটন ।
লিটনের মুখোমুখি: বাঘের সামনে ছাগল দেওয়ার গল্প
কীভাবে বাঘজরিপ হলো ? শুনেছি ২০০ ছাগল ব্যবহার করা হয়েছে এই বাঘজরিপে।
তার উত্তরে জানা যায়, প্রথমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে আজাদ কবির নামে এক ব্যক্তি।
তিনি সুন্দরবনের করমজলের স্টেশনের ফরেস্টার ছিলেন। তার সঙ্গে লিটনের বোট ভাড়ার একটি চুক্তিপত্র হলো। পরে চূড়ান্ত হয় খুলনা বন্যপ্রাণী সার্কেলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহেদুল কবিরের মাধ্যমে। তার কাছে ৮টি বোট ভাড়া নেন, পরে তা আবার পরিবর্তন করে দুটি সাম্পান ও দুটি জালি বোট ভাড়া নেন। ২০১৩ সালের ১ নভেম্বরে বোট নেমে গেল বনের নোনা জলে।
ছাগল বহন করার জন্য মাসখানেকের জন্য নেওয়া হয়েছিল একটি ছোট জালিবোট। এরপর সেই ছাগলের বোট বিদায় দিয়ে পরে নিজেদের থাকার জালি বোটেই ছাগল আনা নেওয়া করা হতো।
বাঘের মুখে থেকে কাজ করতে হয়েছে তাদের। ডাঙায় নেমে জঙ্গল সাফ করে সেখানে জাল পাতাসহ ক্যামেরা পাতাসহ অনেক ঝুঁকির কাজ করতে হয়েছে। প্রথম দিকে ৩৬/৩৭ জনের মতো কাজ করেছে, পরে আস্তে আস্তে কমিয়ে ২০/২২ জনের কর্মীবাহিনী তৈরি করা হয়। দুটো গ্রুপ হয়ে যায়, একদলে সাত/আট জন সুন্দরবনের কচিখালি, আরেক দল কটকা নামক জায়গায় অবস্থান নেয়। অপর দলেও ছিল ৮/১০জন।
দুই বা দেড় কি.মি. দূরে মাথায় মাথায় ছিল ক্যামেরা। এটা তো জিপিএস এর মাধ্যমে মাপা হতো। প্রায় এক কাঠা জায়গার মতো পুরো জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে ফেলা হতো। বাঘ যেদিক থেকে আসবে এমন ধারণার ওপর দুটো লাঠি কেটে দু’পাশে রেখে ক্যামেরা লাগিয়ে দেওয়া হতো। বাঘ যেদিক দিয়ে আসবে সেদিক দিয়ে ছবি উঠবে। আর মাঝখানে একটি খুঁটিতে একটা ছাগল বাঁধা থাকতো। পরে ছাগল নেতাইলে (চিৎকার) বাঘ চলে আসতো।
বাঘ আজকে না কালকে, কালকে না হলে পরশু চলে আসতো। প্রতি তিনদিন পর পর পরীক্ষা করা হতো। দেখা হতো নির্দিষ্ট জায়গায় বাঘ আসছে কি না। ছাগলের খাবার আছে কি না বা ছাগলটা বাঘ খেয়ে গেছে কি না।
বাঘ অনেক সময় সেখানে বসেই খেত আবার অনেক সময় ছাগল নিয়ে চলে যেত। অনেক সময় যেখানে ছাগল বাঁধা থাকতো সেখান থেকে ছাগল নিয়ে আরেক জায়গায় নিতো যেখানে ক্যামেরার আড়াল হয়ে যেত। এমন অনেক দৃশ্য লিটন দেখেছে- মা তার বাচ্চা নিয়ে আসতো পরে তারা সে ছাগল নিয়ে আধাঘণ্টা পৌনে এক ঘণ্টা খেলা করতো।
ছাগল ছিল অনেক। পর্যাপ্ত ছাগল আনা হয়েছিল চার পিকআপে করে। লিটন এও জানায়, সে কাজ করার সময় অনেক সাংবাদিক তাকে ফোন দেয়। কিন্তু এ বিষয়ে সে কাউকেই কিছু বলেনি। কারণ তাদের এ বিষয়ে তথ্য দিতে মানা করা হয়েছিল।
বনকর্তা আবারও: বাঘের বাড়িতে বাঘেরই সর্বনাশ
খুলনা কয়রা বন অফিসে আবারও বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহিদুল কবিরের মুখোমুখি। এবার আমি খুব শক্ত অবস্থানে, কারণ এবার আমার সব সত্যতা জানা আছে। প্রশ্ন করতেই তিনি আমাকে থামিয়ে দিলেন বরং তিনি কিছু বলতে এগিয়ে এলেন টেবিলের ওপার থেকে মাথা বাড়িয়ে দিলেন।
জাহেদুল কবির যা বললেন-
টোপ দিয়ে বাঘজরিপের বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের একটি মনিটরিং দল জানতে পারে। পরে তারা এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করতে বলেন। কিন্তু টোপ না দিলে যে বাঘ আসবে না তা তো বনকর্তারা জানতেন আগে থেকে।
তবে আর যাইহোক, আমাদের শিখতে হবে তা না হলে আমরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবো।
প্রশ্ন করলাম, লাইভ বেটিং (জীবন্ত টোপ) করা কেমন হয়ে গেল না ?
উত্তর: না, বিষয়টি আমাদের হাতে নাই। সুন্দরবন ওয়েস্ট বেঙ্গল যেমন করে বলছে আমারা সেভাবে করছি।
প্রশ্ন: যদিও আকর্ষিক গন্ধজাতীয় ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে, সেটা বলতে আপনারা কী বলতে চান? এবং সত্যি কি কোথাও ছাগল দিয়ে বাঘের টোপ বানাননি?
উত্তর: হ্যাঁ বানিয়েছি, তবে খুব অল্প পরিসরে বানিয়েছি। আমাদের তো মোট তিনটা ব্লক। পুরো সুন্দরবন তো আর করিনি।
ওয়াইল্ড লাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া, ওরা তো ২০১০ সালে করেছিল। ওরা কিছু পায়নি, দুই একটি পার্গ মার্ক পাচ্ছে একটা দু্টা ক্যাপচার পাচ্ছে। এরপর পরে তারা চিন্তা করে দেখেছে, এভাবে সম্ভব না তাই তারা অল ফাক্টরি ক্লু পেতে এটট্রাকটেন্ট ব্যবহার করেছে পরে সবাই মিলে এটা করেছি।
এটা উপর মহলের নির্দেশে হয়েছে। এটা ছাড়া আপনি কোনও ক্যাপচারও পাবেন না। ওয়াইল্ড লাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া আমাদের কাছে কোনও পেমেন্ট নেয় না, ওরা আমাদের সহযোগিতা করে।
এভাবেই আমাদের সামনে উঠে আসে কীভাবে বাঘ গুনতে গিয়ে বনকর্মকর্তারা বাঘের সর্বনাশ করেছেন। যে বাঘ আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে, পরিবেশ টিকিয়ে রেখে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। সেদিকে তাদের কোনও চিন্তার খোরাকই পাওয়া গেল না।
লেখক: পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী বিষয়ক সাংবাদিক
hossainsohel@gmail.com
প্রাকৃতিক বিস্ময় সুন্দরবনে কদিন আগে বেশ ঘটা করেই গণনা করা হয়েছে বাঘের সংখ্যা। বেশ ভালো কথা। ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশেরই জাতীয় পশুটির প্রকৃত সংখ্যাটা বর্তমানে ঠিক কত তা জানা প্রয়োজন। কিন্তু তারপরও কেন প্রশ্ন উঠছে এই বাঘ গণনা নিয়ে?
এবার সুন্দরবনের বাঘ গণনায় ব্যবহার করা হয়েছে ‘ক্যামেরা ট্র্যাপিং’ বা ফাঁদ পেতে ছবি তোলা পদ্ধতি। এর আগে সর্বশেষ ২০০৪-০৫ সালে পাগ-মার্ক বা পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে এই বাঘশুমারি করা হয়েছিল। সে পদ্ধতিতে নাকি ত্রুটি থাকায় এবার আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, বন বিভাগের লোকজনের ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের জন্য ব্যবহৃত পদ্ধতি নিয়ে। জানা গেছে, অল্প সময়ে বেশি কাজ আদায়ের জন্য সুন্দরবনে না কি বাঘকে আকৃষ্ট করতে বেটিং করা হচ্ছে।
এখানে বেটিং এর মানে হলো টোপ দেওয়া। অথবা খাবারের লোভ দেখিয়ে কোনও পশুপাখির ছবি তোলা বা পশুকে পাখিদের হাতের নাগালে আনার চেষ্টা করা। অনেক সময় বনে বিভিন্ন জন্তুকে হাতের নাগালে পাওয়ার জন্য শিকারীরা জীবন্ত কোনও প্রাণী বেঁধে রাখেন বা কোনও গন্ধ হয়ে যাওয়া পচা প্রাণীর মৃতদেহ ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুসারে সংরক্ষিত প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে থাকা বন্যপ্রাণীদের জন্য কোনও ধরনের টোপ বিশেষ করে গৃহপালিত জীবজন্তু টোপ হিসেবে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষেধ। কারণ এর মাধ্যমে বনের প্রাণীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকসহ নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে চরম হুমকির মুখে পড়তে পারে বন্য প্রাণীর সংখ্যা। কিন্তু তারপরও আইন লঙ্ঘন করেই চালানো হয়েছে এই বেটিং।
কীভাবে কাজ করে ক্যামেরা ট্র্যাপিং:
বর্তমানে ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয়। এ পদ্ধতিতে কোনও মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্যপ্রাণীদের ছবি পাওয়া যায়। বন্যপ্রাণী চলাচলের রাস্তায় দীর্ঘ মেয়াদের ব্যাটারিচালিত ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। এরপর মানুষহীন এ ক্যামেরার সামনে যে নড়াচড়া করবে তখনই উঠতে থাকবে একের পর এক ছবি। এভাবে গবেষকরা পাচ্ছেন দিন বা রাতের আঁধারে লুকিয়ে থাকা বন্যপ্রাণীদের চারিত্রিক বৈশিষ্টসহ নতুন সব তথ্য।
বনবিভাগের অক্কেলহীন কর্মকাণ্ডের দলিল
সুন্দরবনে বাঘজরিপের ছাগলকে টোপ বানানো হয়েছে। বেশ কদিন ধরে এমন কথা কানে আসছিল। কিন্তু স্পষ্ট উৎস খুজে পাচ্ছিলাম না। সুন্দরবনের বাঘ ছাগলের যে গল্প কানে এসেছে আমার কাছে এর গুরুত্ব অবশ্য আলাদা। এর আগেও এমন কর্মকাণ্ডের নজির আছে। বাঘ ছাগলের কানাকানির খবরের অস্বচ্ছতা নিয়ে মাস দুয়েক কেটে গেল।
২০১৪ সেপ্টেম্বর মাস। একটি ফোন। ওপাশের একজন বললেন, সুন্দরবনের ভেতরে ছাগলকে টোপ বানিয়ে বাঘের জরিপ করা হচ্ছে সন্ধান করে দেখুন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তিটি বনবিভাগে কর্মরত আছেন। তাই বিশ্বাসের পাল্লা খানিকটা ভারি হলো। সে সাথে একটু বিপদেও ফেলে দিলেন তিনি। কারণ এর বেশি আমাকে কিছুই বললেন না। যাইহোক মাস দুয়েক আগে কানের পাশে কানাকানি তাহলে ভুল ছিল না।
বনকর্তার ফোনালাপের আরও চারদিন পর একজন বন্যপ্রাণী চিত্রগ্রাহক জানালেন আরও কিছু। তার বক্তব্য আরও ভয়ঙ্কর। সুন্দরবনের ভেতরে একটি নয় প্রায় ৫০টি ছাগলকে বেটিং করে বা টোপ বানিয়ে বাঘজরিপ চলছে। এমন কথা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। সুন্দরবন শুধু সংরক্ষিত বন নয় বরং নানা বৈচিত্র্যময় প্রজাতির একটি জীবন্ত গবেষণাগার। ২০১২ সালে সংশোধিত বন্যপ্রাণী আইন তো বটে পুরো বিশ্বে বাঘের অভয়ারণ্যে বাস্তুসংস্থানের ব্যাঘাত ঘটিয়ে গৃহপালিত জীবজন্তু প্রবেশ করানো আইনবহির্ভূত কাজ। কারণ সুন্দরবনের বিচরণ করা প্রতিটি প্রাণী খাদ্যশৃঙ্খলে একে অপরের সহযোগিতায় বেঁচে থাকে। যেখানে মানব সভ্যতার কোনওরকম হস্তক্ষেপ প্রয়োজন পড়ে না। তাই মানুষের গৃহপালিত প্রাণী সুন্দরবনে প্রবেশ করালে শুধু সুন্দরবনের নয় যেকোনও বন্যপরিবেশ বিপর্যয়ে পড়তে পারে।
অন্যদিকে বাঘের টোপ যখন ছাগল তখন জানার খাতিরে অনেক প্রাণীবিদদের সঙ্গে কথা হলো। এক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য স্পষ্ট, পৃথিবীতে কোনও বিজ্ঞানে বলা নেই যেখানে বুনো বাস্তুসংস্থান চক্র বা সংরক্ষিত বনে কোনও গৃহপালিত পশুপাখি প্রবেশ করানো হয়। এটি প্রকৃতি বিরুদ্ধ আচরণ এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রকৃতির ধ্বংসের একটি পায়তারা।
সময় গড়িয়ে যায়, বিষয়টি সত্যি যদি হয় তাহলে এটি পৃথিবীতে নজিরবিহীন একটি ঘটনা। সাংবাদিকতার খাতিরে এটি জানা আছে যে, এ বিষয়ে কেউ মুখ খুলবে না। এরপরও জরিপের বিস্তারিত তথ্য বাঘের স্বার্থেই জানতে হবে এবং সবাইকে জানাতে হবে। তাই পিছিয়ে থাকলে চলবে কেন!
উপরে বলেছি, বনবিভাগের যে ব্যক্তি আমাকে ফোনে জানিয়েছিলেন, আবার ফোন দিলাম তাকে। যদিও শর্ত ছিল তার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে না। গতি না পেয়ে শর্ত ভেঙে তার কাছে এবার জানতে চাইলাম জরিপের কাজে নিয়োজিত ছাগল সরবরাহকারী কে।
ঢাকা থেকে ছাগল বিক্রেতা ফোন দিয়ে প্রায় ৫০টি ছাগল কেনার কথা বলি। এরপর নানান কথায় জানতে পারলাম সে খুলনা বন অফিসে ছোট পদে চাকরি করে। সে ছাগল বিক্রেতা নয় বনকর্তার নির্দেশে সে ছাগল সংগ্রহ করেছিল। তবে এতো ছাগল সরবরাহের কথায় সে প্রতিটি ছাগল ২৫০০ টাকা করে দেবে বলে জানালো। যদিও তিনি বিক্রেতা নয়। আরও জানালো ছাগল সংগ্রহে তার সময় লাগবে, কারণ বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাগলগুলো সংগ্রহ করতে হবে। কথার ছলে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- বনবিভাগ কী কারণে ছাগল নিয়েছিল এবং সংখ্যা ঠিক কত। সে এসব কথার উত্তর দিতে চাইল না। আমি আর চাপাচাপিতে না গিয়ে বরং তার সঙ্গে খুলনায় দেখা করার তারিখ ঠিক করলাম।
আলতাফের মুখোমুখি: ছাগল কেনার গল্প
ঢাকা থেকে খুলনা কয়রা বন অফিসের সামনে। বয়স চল্লিশেরও বেশি। তার নাম আলতাফ। লুঙ্গি পরে নির্দিষ্ট একটি চায়ের দোকানে এলো। কিছু সময় নিল আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে। আমার পরিচয় তার কাছে ছাগল ক্রেতা হিসেবে।
যাইহোক, আলতাফের সঙ্গে কথা এগিয়ে চলছে। সেইসঙ্গে ছাগল দিতে তার কতদিন লাগবে এবং কত দাম পড়বে। এসব কথোপকথনের মাঝে এবার যা শুনলাম তাতে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। বাঘজরিপের জন্য ৫০টি নয় প্রথম ধাপে ২০০টি ছাগল সংগ্রহ করেছে বনবিভাগ।
আলতাফ বলে চললো, বড় স্যার মানে বিভাগীয় কর্মকর্তা জাহেদুল কবিরের নির্দেশে কয়েক দফায় ছাগল কেনা হয়েছিল। কোনওটা ২২০০ আবার কোনওটা ২৫০০ টাকা করে পড়েছিল। আমরা তো প্রায় শ দুয়েক ছাগল কিনেছিলাম। প্রতিবার ৫০টি করে ছাগল কেনা হয়েছে। একজন ফরেস্ট রেঞ্জারের বাড়ি খুলনায় তার গ্রাম থেকে কেনা হয়েছে। সরকারি জিনিস তাই সব কাগজপত্র দিয়ে কেনা হয়েছে। তবে যে যার লাভ করে নিয়ে এরপর সরকারি দাম দেওয়া হয়েছে। ছাগল কিনে এরপর ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে জানায়, ছাগলে যদি কোনও জীবাণু থাকে। জীবাণু থাকলে তো বাঘ মারা যেতে পারে। ছাগল দিয়ে কী করলো? এমন প্রশ্নের উত্তরে আলতাফ বলল, ছাগল বাঘের সামনে দেওয়া হয়েছিল, এরপর সেখানে সিসি ক্যামেরা লাগানো ছিল। তারপর বাঘ আসতো এবং ছবি তোলা হতো। এরপর ছাগলগুলোর কী হতো? এই প্রশ্নের উত্তরে সে বলে- বাঘ সব ছাগল খাইয়া চলে যাইতো। কোনও ছাগল আর ফিরে আসেনি।
বনকর্তার মুখোমুখি: মিথ্যাচার ও টালবাহানা
আলতাফের সঙ্গে আলোচনার পর এবার মুখোমুখি বিভাগীয় বনকর্তা জাহিদুল কবিরের কাছে। তার সঙ্গে আগে কোথাও দেখা হয়নি তবে টিভি ও পত্রিকার কল্যাণে আমাকে চিনে নিলেন।
প্রশ্ন: আপনি বাঘজরিপে কেনও ছাগলকে টোপ বানিয়েছেন?
উত্তর: এমন বাজারি তথ্য আপনারা কোথায় পান? কেউ বললো আর সব হয়ে গেলো?
প্রশ্ন: এই ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন ?
উত্তর: হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়েন
প্রশ্ন: আপনারা বাঘজরিপের জন্য প্রথম ধাপেই অনৈতিকভাবে ২০০টি ছাগল সুন্দরবনে প্রবেশ করিয়েছেন।
এরপর তিনি পুরোটাই অস্বীকার করে আমাকে আবারও অনেক কিছু বোঝানো শুরু করলেন।
ওনার সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, আমাদের আসলে প্রমাণ দরকার। এই প্রমাণ যোগাড় করতে প্রয়োজন নৌকা চালককে। তাকে পেলে জানা যাবে কীভাবে বাঘের সামনে ছাগলকে টোপ বানিয়ে রেখেছিল।
পুরো দুদিন সন্ধানের পর লিটন নামের নৌকাচালককে অবশেষে পেলাম মংলার মামা ঘাট নামক মংলাই নদীর তীরে। বাঘজরিপের প্রথম পর্বের সঙ্গে জড়িত ছিল লিটন ।
লিটনের মুখোমুখি: বাঘের সামনে ছাগল দেওয়ার গল্প
কীভাবে বাঘজরিপ হলো ? শুনেছি ২০০ ছাগল ব্যবহার করা হয়েছে এই বাঘজরিপে।
তার উত্তরে জানা যায়, প্রথমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে আজাদ কবির নামে এক ব্যক্তি।
তিনি সুন্দরবনের করমজলের স্টেশনের ফরেস্টার ছিলেন। তার সঙ্গে লিটনের বোট ভাড়ার একটি চুক্তিপত্র হলো। পরে চূড়ান্ত হয় খুলনা বন্যপ্রাণী সার্কেলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহেদুল কবিরের মাধ্যমে। তার কাছে ৮টি বোট ভাড়া নেন, পরে তা আবার পরিবর্তন করে দুটি সাম্পান ও দুটি জালি বোট ভাড়া নেন। ২০১৩ সালের ১ নভেম্বরে বোট নেমে গেল বনের নোনা জলে।
ছাগল বহন করার জন্য মাসখানেকের জন্য নেওয়া হয়েছিল একটি ছোট জালিবোট। এরপর সেই ছাগলের বোট বিদায় দিয়ে পরে নিজেদের থাকার জালি বোটেই ছাগল আনা নেওয়া করা হতো।
বাঘের মুখে থেকে কাজ করতে হয়েছে তাদের। ডাঙায় নেমে জঙ্গল সাফ করে সেখানে জাল পাতাসহ ক্যামেরা পাতাসহ অনেক ঝুঁকির কাজ করতে হয়েছে। প্রথম দিকে ৩৬/৩৭ জনের মতো কাজ করেছে, পরে আস্তে আস্তে কমিয়ে ২০/২২ জনের কর্মীবাহিনী তৈরি করা হয়। দুটো গ্রুপ হয়ে যায়, একদলে সাত/আট জন সুন্দরবনের কচিখালি, আরেক দল কটকা নামক জায়গায় অবস্থান নেয়। অপর দলেও ছিল ৮/১০জন।
দুই বা দেড় কি.মি. দূরে মাথায় মাথায় ছিল ক্যামেরা। এটা তো জিপিএস এর মাধ্যমে মাপা হতো। প্রায় এক কাঠা জায়গার মতো পুরো জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে ফেলা হতো। বাঘ যেদিক থেকে আসবে এমন ধারণার ওপর দুটো লাঠি কেটে দু’পাশে রেখে ক্যামেরা লাগিয়ে দেওয়া হতো। বাঘ যেদিক দিয়ে আসবে সেদিক দিয়ে ছবি উঠবে। আর মাঝখানে একটি খুঁটিতে একটা ছাগল বাঁধা থাকতো। পরে ছাগল নেতাইলে (চিৎকার) বাঘ চলে আসতো।
বাঘ আজকে না কালকে, কালকে না হলে পরশু চলে আসতো। প্রতি তিনদিন পর পর পরীক্ষা করা হতো। দেখা হতো নির্দিষ্ট জায়গায় বাঘ আসছে কি না। ছাগলের খাবার আছে কি না বা ছাগলটা বাঘ খেয়ে গেছে কি না।
বাঘ অনেক সময় সেখানে বসেই খেত আবার অনেক সময় ছাগল নিয়ে চলে যেত। অনেক সময় যেখানে ছাগল বাঁধা থাকতো সেখান থেকে ছাগল নিয়ে আরেক জায়গায় নিতো যেখানে ক্যামেরার আড়াল হয়ে যেত। এমন অনেক দৃশ্য লিটন দেখেছে- মা তার বাচ্চা নিয়ে আসতো পরে তারা সে ছাগল নিয়ে আধাঘণ্টা পৌনে এক ঘণ্টা খেলা করতো।
ছাগল ছিল অনেক। পর্যাপ্ত ছাগল আনা হয়েছিল চার পিকআপে করে। লিটন এও জানায়, সে কাজ করার সময় অনেক সাংবাদিক তাকে ফোন দেয়। কিন্তু এ বিষয়ে সে কাউকেই কিছু বলেনি। কারণ তাদের এ বিষয়ে তথ্য দিতে মানা করা হয়েছিল।
বনকর্তা আবারও: বাঘের বাড়িতে বাঘেরই সর্বনাশ
খুলনা কয়রা বন অফিসে আবারও বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জাহিদুল কবিরের মুখোমুখি। এবার আমি খুব শক্ত অবস্থানে, কারণ এবার আমার সব সত্যতা জানা আছে। প্রশ্ন করতেই তিনি আমাকে থামিয়ে দিলেন বরং তিনি কিছু বলতে এগিয়ে এলেন টেবিলের ওপার থেকে মাথা বাড়িয়ে দিলেন।
জাহেদুল কবির যা বললেন-
টোপ দিয়ে বাঘজরিপের বিষয়টি বিশ্বব্যাংকের একটি মনিটরিং দল জানতে পারে। পরে তারা এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করতে বলেন। কিন্তু টোপ না দিলে যে বাঘ আসবে না তা তো বনকর্তারা জানতেন আগে থেকে।
তবে আর যাইহোক, আমাদের শিখতে হবে তা না হলে আমরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকবো।
প্রশ্ন করলাম, লাইভ বেটিং (জীবন্ত টোপ) করা কেমন হয়ে গেল না ?
উত্তর: না, বিষয়টি আমাদের হাতে নাই। সুন্দরবন ওয়েস্ট বেঙ্গল যেমন করে বলছে আমারা সেভাবে করছি।
প্রশ্ন: যদিও আকর্ষিক গন্ধজাতীয় ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে, সেটা বলতে আপনারা কী বলতে চান? এবং সত্যি কি কোথাও ছাগল দিয়ে বাঘের টোপ বানাননি?
উত্তর: হ্যাঁ বানিয়েছি, তবে খুব অল্প পরিসরে বানিয়েছি। আমাদের তো মোট তিনটা ব্লক। পুরো সুন্দরবন তো আর করিনি।
ওয়াইল্ড লাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া, ওরা তো ২০১০ সালে করেছিল। ওরা কিছু পায়নি, দুই একটি পার্গ মার্ক পাচ্ছে একটা দু্টা ক্যাপচার পাচ্ছে। এরপর পরে তারা চিন্তা করে দেখেছে, এভাবে সম্ভব না তাই তারা অল ফাক্টরি ক্লু পেতে এটট্রাকটেন্ট ব্যবহার করেছে পরে সবাই মিলে এটা করেছি।
এটা উপর মহলের নির্দেশে হয়েছে। এটা ছাড়া আপনি কোনও ক্যাপচারও পাবেন না। ওয়াইল্ড লাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া আমাদের কাছে কোনও পেমেন্ট নেয় না, ওরা আমাদের সহযোগিতা করে।
এভাবেই আমাদের সামনে উঠে আসে কীভাবে বাঘ গুনতে গিয়ে বনকর্মকর্তারা বাঘের সর্বনাশ করেছেন। যে বাঘ আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে, পরিবেশ টিকিয়ে রেখে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। সেদিকে তাদের কোনও চিন্তার খোরাকই পাওয়া গেল না।
লেখক: পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী বিষয়ক সাংবাদিক
hossainsohel@gmail.com
Subscribe to:
Posts (Atom)